ছোট্ট তুবাকে পুলিশ কর্মকর্তার আবেগঘন খোলা চিঠি

08 February 2022

Image


তাসমিন তুবা। বয়স ৪ বছর। ছলছলে চোখে তাকিয়ে রয়। মা নিচে গেছে ড্রেস আনতে। মা আসার পর ভাত খাওয়াবে। না এলে ভাত মুখে নেবে না।
তুবা এখন বুঝে উঠতে পারছে না তার মা আর আসবে না। চিরতরে তাকে ছেড়ে চলে গেছে পরপারে।
ছোট্ট এই তুবাকে ভর্তির জন্য বাড্ডার একটি স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়েই শনিবার ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তাসলিমা বেগম রেনু (৪০)। রোববার লক্ষ্মীপুরের রায়পুরার সোনাপুর গ্রামে তার দাফন হয়েছে।
তাসলিমা রেখে গেছেন ৪ বছর বয়সী তুবা ও ১১ বছর বয়সী ছেলে তাহসিনকে। তাহসিল মায়ের মৃত্যুর বিষয়টি বুঝতে পারলেও নাছোরবান্দা তুবা। ছোট্ট এই শিশুটি এখনও মায়ের ফিরে আসার প্রতীক্ষায়।
মায়ের কথা মনে পড়লেই কেঁদে উঠছে সে। তখন তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখছে স্বজনরা। কখনো বলছে, আম্মু নিচে গেছে। তার জন্য ড্রেস নিয়ে আসবে। কখনো মজার খাবারের আশ্বাস দিয়ে চুপ রাখছে। কখনো বিভিন্ন রকমের খেলার সামগ্রী দিয়ে মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রাখছে।
মা-হারা সেই তুবাকে আবেগঘন এক খোলা চিঠি লিখেছেন ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন) ইফতেখায়রুল ইসলাম ইফতি।
চিঠিটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
প্রিয় মা তুবা,
যখন তোর ছোট্ট চেহারাটি দেখেছি টিভি পর্দায় তৎক্ষণাৎ আমি আমার মেয়েটির কথা ভেবেছি! ঠিক তোর মত ছোট্ট একটি মেয়ে আছে আমার!
জানিস, তুবা তোর আর আমার মাঝে অনেক মিল মা। আবার অনেক অমিলও আছে…
আমি পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান তুই ও ছোট্ট তাইনা মা? আমার বাবা নেই, তোর বাবা থেকেও নেই! আমি মা হারিয়েছি আজ থেকে তিন বছর আগে ঠিক এই জুলাই মাসে, তুইও মা হারালি জুলাই মাসে। আমি প্রতি বছর ২২ জুলাই মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি এখন থেকে তুইও করবি তবে দু’দিন আগে, ২০ জুলাই।
তোর অনেক প্রশ্ন আছে আমি জানি, সবাই মনে করছে তুই কিছুই বুঝছিস না! তুই মনে মনে মায়ের ফিরে আসার প্রতীক্ষা করছিস, তাই নাহ্? জানিস আমিও প্রতীক্ষা করি… আমাদের দুজনের কারো প্রতীক্ষাই শেষ হবে না! তুই অবশ্য প্রশ্ন করতে পারিস আমাকে, আমার মা কিভাবে চলে গেলেন? আমার মা আমাকে প্রতিষ্ঠিত করে স্বাভাবিকভাবেই ওপারে চলে গেছেন!
তুই কি তোর মা কিভাবে চলে গেছেন, তাও জানতে চাস মা? তোর মাও তোকে ঠিক আমার মত প্রতিষ্ঠিত করতে স্কুলে ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন! ওখানে হলো কি মা, কিছু মস্তিষ্ক বিবর্জিত ঠান্ডা মাথার খুনী খেলার ছলে তোর মাকে মার, মার,মার…. বলে মারতেই থাকলো… মনে করলো এটা যেন একটা পুতুল! অবিকল মানুষের চেহারার মত কতগুলো অমানুষ শুধু মেরেই গেছে তোর অভাগিনী মাকে….. তুই হয়তো তাদের কাউকে দেখলে চাচা, মামা বলে ডাকতি! হয়তো কাছে থাকলে বলতি, আমার মাকে মেরো না, আমার মাকে মেরোনা.. ওই পাষন্ডদের কানে তোর মা ডাক পৌঁছাত কিনা তাতে যদিও সন্দেহ আছে আমার। ওই অমানুষগুলো একটিবারের জন্য তোর কথা ভাবেনি মা! ওদের অনেকের ঘরেই তোর মত তুবা আছে। ফুলের মত সাজিয়ে রাখে নিজেদের তুবাকে! তুই তুবাকে নিয়ে ওদের ভাবনার একটুকুও সময় নেই মা!
জানিস মা তোর এই চাচারা রাস্তায় অনেক অন্যায় হয়ে গেলে টু শব্দটিও করেনা! তখন মুখে কুলুপ এঁটে, হাতে চুড়ি পড়ে বসে থাকে। এরা কেউ কেউ তখন উট পাখির মত মুখ লুকিয়ে ফেলে। এরা সোচ্চার হয় অসহায়, সম্বলহীন, দুর্বলের উপর! তখন এদের পুরুষত্ব খুব জেগে উঠেরে মা….!
তুবা মা, ওখানে তোর একটা চাচাও ছিল না যে প্রতিবাদ করে বলবে না মারিস না, আইন ভঙ্গ করিস না! একটা চাচাও তোর মায়ের নিথর দেহের উপরের আঘাত গুলো ফিরায়নি মা…
তোর মাতো তোকে একটুও ব্যথা পেতে দেয়নি কখনো ? আঘাত পেলেও হয়তো আদর করে দিতেন খুব করে তাই না? তুই মা নিজের মায়ের নিথর দেহটা ছুঁয়ে একটু আদর করে দিস কেমন! পারলে একটু জড়িয়ে ধরিস মা…যদি পারিস জড়িয়ে ধরে একটু চিৎকার করে কাঁদিস মা……..! তাতে তোর ছোট্ট বুকটা একটু হালকা হবে কিনা জানিনা আমি..আর কখনো তো জড়িয়ে ধরতে পারবি না মাকে, তাই একটু বেশি করে মমতাময়ী মায়ের দেহটা ছুঁয়ে দিস..
এই কঠিন পৃথিবীতে দুদিন পর সবাই তুবাকে ভুলে যাবে, তোর তো বেঁচে থাকার জন্য একটা স্মৃতি লাগবে তাই না! মায়ের সাথে শেষ স্মৃতিটুকু ধরে রাখিস মা…. আমি কিন্তু ওই স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছিরে মা…..
মা তোর মায়ের হত্যাকারীরা এখন ঘরে চোরের মত লুকিয়ে আছে! দেখে দেখে এই খুনকে যারা জায়েজ করেছে তারাও চুপ! তোর মায়ের খুনীরা আইনের আওতায় অবশ্যই আসবে, সেটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। কিন্তু এতে আমার কোনো ভাল লাগা, মন্দ লাগা কাজ করছে না! আমি জানি তুই আইন, আওতা কিছুই বুঝিস না। এসবের কোনো মানেও নাই তোর কাছে। আমি শুধু ভাবি রাতে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে তুই যখন মা বলে ডাকবি, তখন কে দাঁড়াবে তোর পাশে? কে তোর ছোট্ট মুখটা তুলে কান্না মুছিয়ে দিয়ে বলবে, আয় তুবা মা, আমার বুকে আয়? এই বিশাল পৃথিবীতে তোর ছোট্ট আকাশকে কে আগলে রাখবে? আমার সাথে সাথে তোর বুকটাও খালি হয়ে গেলরে মা!
আমি যখন কেঁদে কেঁদে মায়ের জন্য বুক ভাসাতাম তখন তোর ছোট্ট বোন আমার বুকে এসে আমার বুকটা ঠান্ডা করতো! তোর ছোট্ট বুকটা কার পরশে ঠান্ডা হবে রে মা? আমি জায়নামাজে বসে তোর জন্য বারবার কাঁদছি… আমিও হয়তো ব্যস্ততায় তুই তুবাকে ভুলে যাবো, চেষ্টা করবো মনে রাখতে মা…. এই পৃথিবীটাকে এর মানুষেরা নোংরা বানিয়ে ফেলছেরে মা! স্বার্থের এই দুনিয়ায় কিছু অসভ্য, বর্বর মাথা তুলে জেগে উঠে অসময়ে! সঠিক সময়ে এরা কখনো জেগে উঠে না মা…
তুবা জানিস, আজ আমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী! মহান আল্লাহর কাছে আমার প্রতিটি প্রার্থনায় মায়ের পাশাপাশি তোকেও রাখার চেষ্টা করবো মা… তুই তো আমারও মেয়ে হতে পারতি? এটা ভাবলেই আমার পুরো পৃথিবীটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মা… যেভাবে পারিস নিজের ছোট্ট বুকটাকে ঠান্ডা রাখিস! আমি তোর বাবা হলে সারাক্ষণ তোকে আগলে রাখতাম মা, তোর বদনসীব বাবা কি করবেন আমি জানিনা!
মহান আল্লাহ পৃথিবীর নোংরা মানসিকতার সকল অমানুষদের থেকে তোকে নিরাপদে রাখুক মা…
তুই আমাদের মাফ করিসনা তুবা, আমাদের অভিশাপ দিস! তোর অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যাক সকল অমানুষের দল…
ইতি তোর পুলিশ চাচ্চু

প্রসঙ্গত, শনিবার সকালে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসেন তাসলিমা বেগম। তার দুই সন্তানের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে স্কুলের গেটে কয়েকজন নারী তাসলিমার নাম-পরিচয় জানতে চান। পরে লোকজন তাসলিমাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে কয়েকশ লোক একত্র হয়ে তাসলিমাকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যায়। স্কুলের ফাঁকা জায়গায় এলোপাতাড়ি মারপিট করে গুরুতর জখম করে। পরে উদ্ধার করে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন তিনি মারা যান। এ ঘটনায় তাসলিমার বোনের ছেলে সৈয়দ নাসিরউদ্দিন বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় অজ্ঞাতনামা চারশ থেকে পাঁচশ মানুষকে আসামি করে মামলা করেন।
নিহত তাসলিমার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে। মহাখালীতে চার বছরের মেয়ে ও মাকে নিয়ে থাকতেন তাসলিমা। দুই বছর আগে স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ১১ বছরের এক ছেলেও আছে নিহত তাসলিমার।